OrdinaryITPostAd

হিসাব বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ || History of Accounting

হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশঃ

মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতো হিসাববিজ্ঞানও হাজার বছরের প্রাচীন ও বৈচিত্র্যময় একটি বিদ্যা। সভ্যতার পরিবর্তনের ধারায় ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রয়োজনে হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। হিসাববিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাসকে কয়েকটি যুগে ভাগ করা যায়।

১। প্রস্তর যুগ:

প্রাচীনকালে মানুষ তাদের গুরুত্বপূর্ণ হিসাবসমূহ সংরক্ষণ করতো বিভিন্ন প্রাচীন পদ্ধতিতে যেমনঃ গাছের গায়ে, গুহায় বা পাথরে চিহ্ন দিয়ে, রশিতে গিঁট দিয়ে, পশুর চামড়া, গাছের বাকল ও পাতায় লিখে ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের প্রাচীন পদ্ধতিতে রাখত। আদিম কালে মানুষ যখন বনে জঙ্গলে বাস করত তখন তারা তাদের সংগ্রহকৃত ফলমূল ও অন্যান্য জিনিসের হিসাব রাখত গাছের গায়ে দাগ কেটে।

একসময় মানুষ পাহাড়ের গায়ে গুহা তৈরি করে গুহায় বসবাস শুরু করে। এসময় তারা গাছের ফলমূল সংগ্রহ করা এবং পশু শিকার করা শিখে। পশু শিকার করাই ছিলো তাদের প্রধান পেশা। মানুষ যখন গুহায় বাস করত তখন তারা তাদের পশু শিকারের সংখ্যা গননা করার জন্য গুহার দেয়ালে বা পাথরের গায়ে দাগ কেটে হিসাব রাখতো। শিকারের হিসাব রাখত গুহার দেয়ালে বা পাথরের গায়ে বিভিন্ন দাগ ও চিহ্ন দিয়ে। অনুমান করা হয় যে, তাদের এ সংখ্যা গণনার ধারণা থেকে হিসাববিজ্ঞানের পথচলা শুরু।

২। প্রাচীন যুগ:

এ যুগে মানুষ পাহাড়ের গুহা হতে বেরিয়ে নদ-নদীর উপকুলে এসে ঘর-বাড়ি তৈরি করে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা শুরু করে এবং শুরু হয় মানবজাতির সামাজিকভাবে জীবনযাপন । এসময় মানুষ মাছ শিকার ও কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহের প্রধান পেশা হিসাবে বেছে নেয়। সেই সময় তারা আদিম পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ফসল গত বছরের তুলনায় কম হয়েছে না বেশি হয়েছে তা নির্ণয় করতো।

এছাড়া তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ মন্দিরে দান করতো। আর কে কতোটুকু দান করল মন্দির কর্তৃপক্ষ তা দেওয়ালে খোদাই করে চিহ্নের মাধ্যমে লিখে রাখতো। এই প্রাচীন দেওয়াল খোদাইগুলোকেও হিসাববিজ্ঞানের প্রাচীন প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। বাকি ফসল নিজেরা খেতো ও পরবর্তী সময়ে চাষের জন্য মজুদ করে রাখত । এভাবেই তারা তাদের উৎপাদিত ও মজুদকৃত ফসলের হিসাব রাখতো ঘরের দেওয়ালে ও বাঁশের গায়ে দাগ কেটে এবং দড়ি বা রশিতে গিঁট দিয়ে। আমাদের দেশে প্রত্যন্ত গ্রামে এখনও এ ভাবে শস্যের হিসাব রাখতে দেখা যায়।

৩। বিনিময় যুগ:

যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সভ্যতার উন্নতি হতে থাকে । একই সাথে মানষের চাহিদারও পরিবর্তন হতে থাকে যা পূরণের জন্য মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ একে অন্যের সাথে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য আদান প্রদান করতে থাকে এবং চূড়ান্ত বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পত্তির লেনদেনের হিসাব রাখতে শুরু করে। তখন এ সকল লেনদেন হিসাব রাখার পদ্ধতিগুলো ছিলো অদ্ভুত। যেমনঃ পেরু দেশে কিপু নামের রঙ্গিন সুতা ব্যবহার করত। চীন দেশে এব্যাকাস নামক এক প্রকার হিসাব যন্ত্র ব্যবহার করতো।

আবার, রানী এলিজাবেথের রাজত্ব কালের আগ পর্যন্ত এক ধরনের চ্যাপ্টা কাঠি (Tally) ব্যবহার করতো। এছাড়াও এই সময়ও গাছের পাতায় আঁচড় দিয়ে, বাঁশের গায়ে দাগ কেটে, কাঠের গায়ে ছিদ্র করে ইত্যাদি ভাবে হিসাব রাখা হতো। এ সময় পর্যন্ত সমাজে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়নি।

৪। মুদ্রা যুগ:

বিনিময় প্রথার অসুবিধাজনিত কারণে মুদ্রাযুগ এর প্রচলন শুরু হয়। এভাবে একসময় কাগজ-কলম আবিষ্কার হলে মানুষ কাগজে হিসাব রাখা ও সংরক্ষণ করা শুরু করে। মুদ্রা প্রচলনের ফলে তখন অর্থের বিনিময়ে পণ্যের মূল্য নিরূপণ করা হয় এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য শুরু হয় যার দ্রুতই ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ সময় পেশাগত ব্যবসায়ী শ্রেণি ধারে পণ্য ক্রয়- বিক্রয় শুরু করে এবং ক্রয়-বিক্রয়, জমা-খরচ, দেনা- পাওনা এবং অন্যান্য লেনদেণের হিসাব লিখিতভাবে হিসাবের বইতে অঙ্কের মাধ্যমে লেখা শুরু হয়। ফলে হিসাব রক্ষার পদ্ধতি আরো উন্নত হয় কিন্তু তখনও কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভব হয়নি।

৫। মধ্য যুগ:

সভ্যতার ক্রমাগত পরিবর্তনে ব্যবসায় বাণিজ্যে এর বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। পঞ্চাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ১৪৯৪ সালে ইতালির একজন বিশিষ্ট গণিতবিদ ও ধর্মযাজক লুকা প্যাসিওলি হিসাব বিজ্ঞানের আধুনিকায়নে সবচেয়ে বিশেষ ভুমিকা রাখেন। তিনি স্থানীয় গীর্জার আর্থিক লেনদেনের হিসাব করার সময় পদ্ধতিগত বিভিন্ন সমস্যা ও ত্রুটি উদঘাটন করেন। লুকা প্যাসিওলি উক্ত সমস্যা সমাধানে “দুতরফা দাখিলা (Double Entry)’’ পদ্ধতি নামে একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক হিসাব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। লুকা প্যাসিওলি দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে 'সুম্মা ডি এরিথমেটিকা জিওমেট্রিয়া প্রপোরশনিয়েট প্রপোরশনালিটা' নামে একটি বই লিখেন। তাঁকে "হিসাববিজ্ঞান ও হিসাবরক্ষণের পিতা" নামে ডাকা হয়। হিসাব রক্ষণের এই “দুতরফা দাখিলা (Double Entry)’’ পদ্ধতি সকল ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রচলন শুরু হয়। আমাদের আজকের হিসাব বিজ্ঞান বইটিও এই দুতরফা (Double Entry)’’ উপর ভিত্তি করেই লেখা।

৬। আধুনিক যুগ:

লুকা প্যাসিওলি এর সময় থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতি হয়। ব্যবসায় যেমন ছোট থেকে বড় হতে থাকে তেমনি এর পরিধিও বৃদ্ধি পেতে থাকে। উৎপাদন ব্যবস্থা ও ব্যবসায়ের উন্নয়নের সাথে সাথে হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থারও যথেষ্ঠ পরিবর্তন এসেছে এবং এর ফলে হিসাববিজ্ঞানেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়।

বর্তমান কম্পিউটারের যুগে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে হিসাবের বই হাতে লিখার পরিবর্তে কম্পিউটার ও ল্যাপটপে করা হয়। পণ্য ক্রয়, বিক্রয়, মজুদকরণ, হিসাব নিকাশ, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ ব্যবসায়ের অন্যান্য হিসাব সংরক্ষণের জটিল এবং ক্লান্তিকর কাজগুলো আজকাল কম্পিউটার সফটওয়্যারের সাহায্যে অনেক দ্রুততার সাথে করা যায়। ফলে সময় ও শ্রম লাঘবের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত দ্রুত গ্রহণ করা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সহজ হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সফটওয়্যারের সাহায্য নেয়া হয়। এই সফটওয়্যারগুলো সচরাচর প্রত্যেকটি প্রধান কার্যক্রমের সাথে অন্তর্নিহিতভাবে সংযুক্ত থাকে; এতে করে একটি তথ্য প্রবেশ করালে তা সমস্ত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এই সফটওয়্যারগুলো দিয়ে একজন কর্মী প্রায় ২০০ মানুষের কাজ একাই করে ফেলতে পারে। এই ধরনের একাউন্টিং সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের কাজ অনেক সহজ করে দেয় এবং এতে করে পণ্য ও সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং অর্থ সাশ্রয় হয়। এতে অনেক বড় ও জটিল হিসাব মুহূর্তেই করে শ্রম লাঘব করা যায়, সংরক্ষণও করা যায়, আবার প্রয়োজনের সময় তা মুহূর্তেই বের করা যায়। এ যুগটি মূলত “হিসাবরক্ষণের কম্পিউটার যুগ” বলে পরিচিতি লাভ করেছে।
আজকাল আমাদের দৈনন্দিন হিসাব রাখতে এখন আমরা কম্পিউটারের পাশাপাশি স্মার্ট ফোনও ব্যাবহার করি। ফোনেও বিভিন্ন সফটওয়্যার ও এপস এর মাধ্যমে সজেই প্রতি মুহূর্তের হিসাব আপডেট করতে পারি। যা একই সাথে কম্পিউটার ও ফোনে সম্পাদনা ও পরিচালনা করা যায়।

বর্তমানে হিসাববিজ্ঞানে বিভিন্ন কৌশল ও প্রযুক্তিকরণ করার ফলে নতুন করে বেরিয়ে এসেছে ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান, বাজেটিয় হিসাববিজ্ঞান, মানব সম্পদ হিসাববিজ্ঞান, সামাজিক হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে হিসাববিজ্ঞানের উন্নতি বর্তমানে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, অব্যবসায়ী, সরকারি, বেসরকারি, মুনাফাভোগী ও অমুনাফাভোগী সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে হিসাববিজ্ঞানের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের হিসাবরক্ষণের মধ্যে সমতা আনার জন্য (Accounting Standard Committee) নামে একটি সংস্থা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ এই সংস্থার একটি সদস্য।

*এভাবে প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে বিনিময় যুগ ও মধ্যযুগ পার হয়ে হিসাববিজ্ঞান এখন আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে।*

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪